চোখ বন্ধ করে একটু ভাবুন তো, আপনার জীবনে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কী?
আপনি ভাবতে থাকুন… ততক্ষণ আপনাকে একটা গল্প শোনাই।
এক ভয়াবহ কৃপণ লোকের বাড়িতে ডাকাত পড়েছে। তিনি বউ-বাচ্চার অনেক হক আদায় না করে এ টাকাগুলো জমিয়েছিলেন। ডাকাত এই কৃপন লোকটিকে বেশ মারধর করেছে কিন্তু এখনো পর্যন্ত মুখ খোলেনি সিন্দুকের চাবি কোথায় রেখেছেন। ডাকাতদের এক সদস্য এবার এক হাতে তার বউয়ের চুলের মুঠি ধরেলেন আর অন্য হাতে ছুরি ধরেছে গলায়। আর চিৎকার করে বলছে, ‘সিন্দুকের চাবি দে, নইলে বউ হারাবি।’
কৃপণ লোকটি চাবি বের করে দিলেন।
মানুষ সবকিছু দিয়ে হলেও আগে তার পরিবারকে রক্ষা করতে চায়। কারণ, মানুষের অবচেতন মন এটা জানে যে কেবল অর্থ-সম্পদ নিয়ে সে ভালো থাকতে পারবে না।
পরিবারের নিরাপত্তার জন্যই মানুষ অর্থ-সম্পদ বাড়াতে চায়। আপনি এক লাখ মানুষকে প্রশ্ন করে দেখবেন, তিনি বিয়ের আগে টাকা জমাতে পেরেছেন, না কি বিয়ের পরে? এক লাখ মানুষই উত্তর দেবে বিয়ের আগে সে কোনো টাকা জমাতে পারেনি, যতটা পেরেছে বিয়ের পর। অথচ অনেকে ভাবেন, বিয়ে করলে খরচ বাড়ে। হা হা হা…!
অনেকগুলো গবেষণাপত্র পড়ার পরে আমি এটা বলতে পারি যে, আমাদের সম্পর্কগুলো প্রথমে আমাদের সুখের স্তরে এবং পরবর্তী সময়ে আমাদের প্রোডাকটিভিটির স্তরে দারুণভাবে সহায়ক।
যেসব পরিবারে দেখবেন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সুসম্পর্ক রয়েছে, তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো।
অনেকে আবার মনে করেন, সবকিছু বাদ দিয়ে আগে আর্থিক অবস্থা ঠিক করি, পরে পারিবারিক সম্পর্ক ঠিক করে নেব।
আবার যেসব ব্যাচেলর মনে করছেন, ক্যারিয়ারটা অথবা আর্থিক অবস্থা একটু ঠিক করে নিই তারপরে দিল্লির লাড্ডু খাব; নিঃসন্দেহে বলতে পারি, এভাবে হবে না। এভাবে কেউ পারেনি। সবাই কেবল চেষ্টা করেছে মাত্র। হে হে হে…!
দেখুন, জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হলো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। যার সাথে আপনি বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেন। এক ছাদের নিচে বসবাস করেন এবং প্রায় সবকিছুই ভাগাভাগি করে নেন। দুর্ভাগ্যক্রমে, আমাদের দেশে বিবাহ বিচ্ছেদের হার দিন দিন বেড়েই চলেছে, এটা নিঃসন্দেহে একাটি বিশাল সংকট। এটা খুব উদ্বেগজনক যে, বিবাহের প্রথম বা দ্বিতীয় বছরে বিবাহ বিচ্ছেদের পরিমাণ বেশি। এটা দেখে আমার মনে হয় যে, পাত্র-পাত্রীর কোন কোন গুণ খোঁজা উচিত, সে সম্পর্কে আমাদের গভীর জ্ঞানের অভাব থাকতে পারে।
কারণ, স্বামী স্ত্রীকে খাবার দিতে পারছে না, এ কারণে তো সংসার ভাঙছে না। তাহলে অন্য কী কারণ? এটা এখন খুঁজে বের করা আমাদের সবার দায়িত্ব।
বৈবাহিক অসন্তোষের পরিণামগুলো সবসময় দীর্ঘমেয়াদি হয়। এরা মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত ও শারীরিকভাবে দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী হয়। বিশ্বাস করুন, কাজের প্রোডাকটিভিটি বাড়ানোর জন্য এ দুটিই খুব দরকার। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ওই নেতিবাচক পরিণতি থেকে রক্ষা করুন।
লোকেরা দিনের পর দিন প্রস্তুতি নেয় বিয়ের জন্য। এমনকি লাখ লাখ টাকা খরচও করেন আনন্দ প্রকাশ করার জন্য। কিন্তু সেই বিয়ে কয়েক বছর, কয়েক মাস, কয়েক দিন এমনকি কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী হয়। ডিভোর্সি মানুষ এখন সবার ঘরেই আছে, আপনার পরিবারেও পাবেন, খুঁজে দেখুন। বারবার সঙ্গী পরিবর্তন করা অথবা ঝগড়া বিবাদের মধ্যে বসবাস করা মানুষ হ্যাপি বা প্রোডাকটিভ কোনোটাই হতে পারবে না কখনই। তাই আপনার দাম্পত্য জীবনকে প্রোডাকটিভ করতে হবে। তবেই আপনি হ্যাপি এবং প্রোডাকটিভ মানুষ হতে পারবেন।
যাই হোক, এত কিছুর পরও আসলে কয়জন মানুষ বিয়ের জন্য প্রস্তুত? যেটা সারাজীবন স্থায়ী হবে। একটি সফল বিয়ের উপযুক্ত মানদন্ডের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী পছন্দ করার এবং নিজেই একজন চমৎকার সঙ্গী হয়ে পাশে থাকার মতো মানসিকতা আছে কজনের?
আল্লাহ কোরআনে এত সুন্দরভাবে আমাদের বিবাহ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন-
‘এবং তার নিদর্শনাবলির মধ্যে আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও এবং তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও সহানুভূতি সৃষ্টি করেছেন; নিশ্চয়ই চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে নিদর্শন আছে।’ সুরা রুম, আয়াত : ২১।
তাহলে আমরা কীভাবে এই ভালোবাসা খুঁজে পাব? কীভাবে আমরা শান্তিতে বাঁচতে পারব? যেমন শান্তির কথা কোরআনে বলা হলো।
বিবাহ দ্বিমুখী প্রক্রিয়া; এটি এমন নয় যে প্রতিটি দম্পতি ৫০% – ৫০% করবে; এটা এভাবে শতভাগ পূর্ণ হয় না। এ ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই ১০০% প্রচেষ্টা থাকা দরকার। তাই বিয়ের আগে আপনার অবশ্যই জানা উচিত কীভাবে আপনি প্রোডাকটিভ স্বামী/স্ত্রী খুঁজে পাবেন।
মনে রাখবেন, একটি প্রোডাকটিভ দাম্পত্য জীবন আপনাকে সামাজিকভাবে সম্মানিত করে, সেক্সচুয়াল হ্যারেজমেন্ট থেকে বাঁচায়, শরীরের চাহিদা মেটায়, ইমান ঠিক রাখতে সাহায্য করে, নিজের মধ্যে ম্যাচুরিটি আনে, দায়িত্বশীলতা ও ফোকাস বুদ্ধি করে, মনে শান্তি দেয়, সময়কে কাজে লাগানো শেখায়। এছাড়াও চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে আরো অনেক নিদর্শন নিশ্চয়ই আছে।
বিয়ের আগেই যে ৫টি বিষয় আপনার জানা উচিৎ!
১. সুখী মানুষকে বিয়ে করুন
বিয়ের পাত্র বা পাত্রীটি সুখী কি না তা সবার আগে জেনে নিন। একজন সুখী মানুষ আপনাকে সুখী হতে সাহায্য করতে পারবে। একজন দুঃখী মানুষ আপনার জীবনটা আরো দুঃখে ভরে তুলবে। বিয়ের আগেই জেনে নিন আপনার পছন্দের মানুষটি সুখী না দুঃখী। তা না হলে পরে পস্তাবেন। আমাদের দেশে মেয়েদের বেলায় সুন্দরী এক ছেলেদের টাকা পয়সা আছে কিনা এইটা অবশ্যই দেখা হয়। এসব দেখুন সাথে জেনে নিন সুখের বেপারটাও জেনেনিন।
২. আচার ব্যবহার এবং বিচার বুদ্ধি কেমন সেটা জানুন
বিয়ের পর কম বা বেশি সমস্যা হবেই। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হবে পরিবারে অন্যদের সঙ্গে হতে পারে। ঝড়া হবে, মনোমালিন্য হবে, কেউ খুশি হবে কেউ দুঃখী হবে সেটা সমস্যা নয়। সেটা কত দ্রুত মিটিয়ে আবার আপন করে দিতে পারে কিনা সটো জানতে হবে। আপনি অবশ্যই তাকে প্রশ্ন করুন কনফ্লিক্ট রেজুলেশন সম্পর্কে তার আইডিয়া রয়েছে কিনা, প্রবলেম সলভিং এবিলিটি কেমন বোঝার চেষ্টা করুন, তার পার্সোনাল হিস্ট্রি জানুন কত জনের সাথে কথা বলেনা কাকে কাকে দেখলে তার পছন্দ হয় না, তার ইমোশনা ইন্টেলিজেন্সি কেমন? এই সবকিছু ঠিক থাকলে বুঝবেন তার নেগোসিয়েশন স্কিলস ভালো সে অবশ্যই দক্ষ ভাবে সম্পর্কে সুন্দর রাখতে পারবে। জানেন তো নেগোসিয়েশন স্কিল ভালো সে উভয়পক্ষকে জিতিয়ে দিতে পারে শুধু নিজের জেতার চেষ্টা করে না। তাই অবশ্যই তার আচার ব্যবহার এবং বিচার বুদ্ধি সম্পর্কে আগেই জেনে নিন।
৩. ধৈর্য্য কেমন
জীবনের জন্য ধৈর্য একটি অপরিহার্য বিষয়। সংসার জীবনে এটি খুব প্রয়োজন। যার ধৈর্য নেই তার সাথে সংসার করা তো দূরের কথা তার সাথে দুই এক ঘন্টার সাথে থাকাটাও খুব কঠিন হয়ে যায়। বিয়ের আগে অবশ্যই জানার চেষ্টা করুন তিনি ধৈর্যশীল কিনা।
তিনি ধৈর্যশীল কিনা এটা বোঝার জন্য তার কমিউনিকেশন স্টাইল দেখুন, লিসেনিং এবিলিটি দেখুন, তার টলারেন্স করার স্টাইল দেখুন, তার পার্সোনাল রিফ্লেকশন দেখুন। আশা করছি আপনি বুঝে যাবেন তার ধৈর্য আছে কি নেই। ধৈর্য না থাকলে তার সাথে সংসার করার মতো রিক্স নেবেন না ।
৪. জীবনের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য জানুন
বিয়ের পাত্র বা পাত্রীর জীবনের লক্ষ্য জানুন, তার জীবনের উদ্দেশ্য জানুন। দেখুন সেখানে ম্যাচ করে কিনা। দুজনের পছন্দ অপছন্দ বোঝার চেষ্টা করুন। আমি একজন দম্পতিকে চিনতাম যে স্বামী বেচারা গান গাইতে পছন্দ করে আর বউটার গান শুনলে মাথা ব্যাথা শুরু হয়, শেষ পর্যন্ত তারা সংসার করতে পারেনি। আর একটা দম্পতিকে চিনতাম জামাই বেচারা একটু মদ খায় বলে বৌ তার সঙ্গে সংসার করেনি। আর এক দম্পতিকে দেখেছি তারা দুজনেই মদ খায় বিয়ের পর তাদের খুব ভালো হয়েছে তারা এখন বাসাতেও আরাম করে খেতে পারে। আমি বউ বাচ্চা নিয়ে তাদের বাসায় গেলে খুব ভয় ভয় ফ্রিজ খুলি যে আবার কিসেনা কিসের বতল বেরিয়ে যায়। দেখুন কে ভাল কে মন্দ এই বিচার করতে এই লেখাটা লিখছি না। আমি কেবল বলতে চাইছি দুজনের মানসিকতা একই কিনা। সেটা বোঝুন।
৫. নিজের ব্যাপারে কথাটা সচেতন সেটা জানুন
কেবল সার্টিফিকেট থাকলেই যে জ্ঞান বুদ্ধি হয় না সেটা এখন আমরা জানি। একজন মানুষ নিজের ব্যাপারে সচেতন কিনা সেটা আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে। কিছু কমন বিষয় আপনি দেখতে পারেন যেমন- সে নামাজ পড়ে কিনা, বিশেষ করে ফজর এবং এশার নামাজ পড়ে কিনা জানুন, বই পড়ার অভ্যেস আছে কিনা, ব্যায়াম করে কিনা, খাবারের সময় ধৈর্যের সঙ্গে খায় কিনা। এসব বিষয়ে জানার অবশ্যই চেষ্টা করুন। যে নিজের ব্যাপারে সচেতন সে অন্যদের বেড়াতেও সচেত। এখন তো বাপ মায়েরা ছেলে মেয়েদের আদর করি নষ্ট করে ফেলে ১৮ বছর পর্যন্ত মুখে তুলে খাওয়ায়, তারা নিজের কাপড়টা পর্যন্ত ভাঁজ করে রাখতে জানে না। বর্তমান সময়ে বেশি ভাগ ছেলে মেয়েদের মধ্যেই কি করতে হবে কি করতে হবে না সে বিষয়ে জ্ঞান যথেষ্ট কম হয়েছে। এখনকার ছেলেমেয়েরা নিজে একটা সহজ বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। দেখুন ষোল কলা কখনোই পূর্ণ হবে না কিন্তু আপনি কলা বারোটা নিলে কোন বারোটা নিবেন সেটা আপনাদেই ঠিক করতে হবে।
আমার ১০ বছরের বিবাহিত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি এই সব কিছু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনি মানুষকে পরিবর্তন করতে পারবেন না তাই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আগেই। আর যদি কোন ভাবে বিয়ে হয়ে যায় কোন কিছু পরিবর্তন করার দরকার হয় তাদের নিজে পরিবর্তন হোন অন্যকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করবেন না। আপনি জানেন নিশ্চয় বাংলাদেশে এখন প্রতিবছর ৫০ হাজার মানুষের ডিভোর্স হয়। এবং এর সংখ্যা প্রতিবছর বেরিয়ে চলেছে। তাই সাবধান।
ডিয়ার হ্যাপি ম্যান যা করবেন বিয়ের আগেই করতে হবে। না হলে দিল্লিকা লাড্ডু বারবার খেতে হবে।