মনের কি যে হলো, জানি না। এই মধ্য বয়েসেই জীবনী লেখার স্বাদ জাগলো। ৩৫ বছর বয়সেতো আর পুরো জীবনী লিখতে পারবো না। তাই আপাতত গত ৩৫ বছরের স্মৃতিগুলো লিখে ফেলি। তারপর না হয়, সময় করে ডায়েরী পাতা ভরাবো নিয়ম করে অনিয়মিতভাবে।
ওহ হো! আমার পরিচয়টাই তো লিখিনি। প্রথমে তো পরিচয় দিতে হয়! এটাই সামাজিক রীতি।
বলা অতি উত্তম যে, আমি মতি মিয়া; প্রচন্ড অসামাজিক মানে নিয়ম কানুন ঐতিহ্য সামাজিকতা ইত্যাদি কম বুঝি বা মানি। ডেকোরাম টেকোরাম আমার মাথায় ঢুকে কম। ঢুকলেও থাকে না বেশীদিন। বয়স এই নভেম্বরে মানে ২০১৯ এর নভেম্বরে ৩৫ সমন্ন হবে। পড়াশোনা কথা এক বাক্যেই বলি, মেট্রিক পাশ। যেহেতু মেট্রিকুলেশন সিস্টেম বহুবছর আগেই বাতিল হয়েছে, তাই বলা উচিত মাধ্যমিক পাশ।
জন্মসূত্রে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাগরিক। জন্মটা বাংলাদেশের কোথায় হয়েছে তা জানি না। জন্মের পরদিন মাকে হারিয়েছি আর বছর কয়েক পরেই বাবাকে। এসব আমাকে বলেছে আমার তীরন্দাজ মামা। তিনিই আমাকে কোলে পিঠে হাতে পায়ে মাথায় করে এতবড় করেছেন।
তীরন্দাজ লোকটা পাগল। আমার শৈশব কৈশোর এমনকি এখন যৌবনের প্রান্তেও এই লোকটা আমাকে আগলে রেখেছে। পেশায় তিনি একজন ভবঘুরে।
তার কাজের ধরনটা ছোটবেলায় খুব ভালো লাগলেও গত কয়েক বছর বিরক্ত লাগছে। কারণ কয়েক বছর তাকে পাশে পাচ্ছি না, দেখাও হচ্ছে না।
তীরন্দাজ মামার কাজের বর্ণনাটা দিয়ে নেই। তিনি এক বছর যে কোন কাজ করবেন, যে কোন মানে যে কোন! ভালো-মন্দ, ছোট-বড়, উঁচু-নিচু, সহজ-কঠিন যে কোন। তারপর সেই এক বছরের জমানো টাকা নিয়ে চলে যাবেন কোন এক বনে বা পাহাড়ে কিংবা সমুদ্রের পাড়ে। সাথে আমাকে নিয়ে যেতেন; কারণ তিনি ছাড়া আমার একূলে কেউই নেই। মহাকিপ্টামি করে সেই জমানো টাকা দিয়ে এক বছর বনে বাঁদাড়ে পাহাড়ে কিংবা সৈকতে শুয়ে বসে আরাম আয়েশে কাটাবেন। তারপর আবার এক বছর কাজ করবেন। এভাবেই উনার জীবন চলছে।
মামার এই জীবনের সাথে আমি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। ভালো লাগতো অনেক।
একবার মামাকে বললাম, মামা আমি স্কুলে ভর্তি হবো!
মামা বললেন,
— কেন?
— আমি পড়াশোনা শিখতে চাই।
— শিখে কি হবেরে মতি?
— জ্ঞানার্জন করতে হবে তো!
— এই প্রকৃতির চেয়ে বড় কোন স্কুল নাই, শিক্ষক নাই।
— ধ্যাৎ! তাই বলে ব্যাগ কাঁধে স্কুলে যাবার মজাটা অনুভব করবো না?
মামা অট্টহাসি দিয়ে বললেন, তাহলে তোকে একটা ব্যাগ কিনে দিবো! তুই সকালে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঝাউ বাগানে এসে সমুদ্রের ঢেউ গুনবি। ঝাউবন তোর স্কুল, সমুদ্র তোর ক্লাস।
যাই হোক। মহাকষ্টে এখানে এক ক্লাস, ওখানে এক ক্লাস করে মাধ্যমিকটা পেরিয়েছি।
তীরন্দাজ মামা এখন কোথায় আছে জানি না! গতমাসে একটা ফোন করেছিলো। জানালো তিনি এখন শ্রীমঙ্গলে আছেন। হাইওয়ের নির্মাণের কোন একটা কাজ করছেন। আর ৩ মাস পর কাজ শেষ হলেই কোথাও গিয়ে প্রকৃতির সাথে থাকবেন।
আপনাদের মত আমিও মাঝে মাঝে হাসি প্রচন্ড। এযুগেও এমন পাগল মানুষ আছে তাহলে।
আমার আবাস এখন, মেঘডুবি গ্রামে। রাজধানী ঢাকা শহরের পাশেই একটা গ্রাম। গত দু বছর আছি এখানে। এই গ্রামে আজীবন থাকতে চাই। অন্য আহামরী কোন কারণ নেই। একটাই কারণ, আর তা হলো, এই গ্রামের নাম। মেঘডুবি শুনলেই কেমন মনটা চমকে উঠে। দু বছর আগে এখানে এসেছিলাম একটা লেখা জমা দিতে। তারপর আর ফিরে যাইনি। আপনাদেরকে তো আমার পেশাটাই বলা হয়নি। আমাকে প্রথম দেখে মেঘডুবি গ্রামের একজন প্রবীণ ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিলো আমার পেশা কি? আমি হাসতে হাসতে সোজা সাপ্টা উত্তর দিলাম,
— আমি মেট্রিক পাশ গবেষক।
— তুমি কি পাগল? নাকি বেয়াদব?
— জ্বী! আপনি যে কোন একটা ভেবে নিতে পারেন।
— তাহলে তুমি বেয়াদবই।
— আমি পাগল না কেন?
— পাগল হইলে, মেট্রিক ফেল গবেষক হইতা।
পেশায় আমি মেট্রিক পাশ গবেষক। আমি শতভাগ বিশ্বাস করি যে, আমার নিজের কোন গুণ নাই। শুধু একটা অভ্যেস আছে। সেটা হলো, না খেয়ে-দেয়ে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত বই পড়ে যেতে পারি। যে কোন বই। তাই অনেকেই আমাকে বই পড়ার কাজ দেন। যেমন ধরুন আপনি মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ের উপর গবেষনা করে একটা সারমর্ম লিখে দিতে বললেন। এ সারমর্ম লিখার জন্যে আমি বায়োলজি, সাইকোলজি, গণিত, ইতিহাস এবং আরো কিছু বিষয়ের মোট ৪৫টা বই পড়ে একখানা সারমর্ম লিখে দিলাম। এর বিনিময়ে আপনি আমাকে টাকা দিবেন। সেই টাকাই আমার বেতন।
আমার বন্ধু বলে কেউ নেই। তীরন্দাজ মামা আছে বলাটাও মুশকিল। তাই বন্ধু-টন্ধু বলতে ওই একটাই বস্তু, বই।
বই অনেকটা গাছের মত জীবন্ত। নড়তে চড়তে পারে না। কিন্তু প্রাণের ভেতর প্রাণ সঞ্চয় করে, সঞ্চারও করে।
আমার পরিচয় দেবার মতো আর কিছু নেই। সন্ধ্যা হয়ে এলো! যাই, এবার একটু বিরতি নিয়ে পাটোয়ারীর দোকান থেকে এক কাপ আদা চা খেয়ে আসি। নইলে পাটোয়ারী ছেলেটা মন খারাপ করবে। ফিরে এসে সময় করে আবার লিখতে বসবো। সুতরাং পরিচয় পর্বটা আপাতত এখানে শেষ করি।
ও আচ্ছা! একটা কথা ভুল বলেছি, আমি একা থাকি না! আমার সাথে আমার প্রিয় বিড়াল কর্ণিয়া থাকে। সেও আমার পেছন পেছন তার ডোরা কাটা শরীর আর কালো লেজটা হালকা নাড়াতে নাড়াতে পাটোয়ারীর দোকানে যেতে প্রস্তুত। মিউমিউ করে জানান দিচ্ছে আমাকে যে, সময় হয়েছে চা খাবার। তাহলে আমরা চা খেতে গেলাম।
May long live Hasan Zaman