23 C
Dhaka
হোম সিরিজথ্রিলার সিরিজমতি মিয়ার ডায়রী | পর্ব ২

মতি মিয়ার ডায়রী | পর্ব ২

অবন্তিকা আলাপনঃ

আজ ৬ অক্টোবর ২০১৯।

একটু আগে মানে ৯টায়, পাউরুটি আর ডিম খেয়েছি! সকাল থেকে কর্ণিয়াকে দেখছি না। বোধহয় কোথাও লুকিয়ে থেকে আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে। আমিও ব্যাপারটা বুঝে, দুঃশ্চিতার ভান করে তাকে খুঁজি! কি বুদ্ধিমান কর্ণিয়াটা।

ভেবেছিলাম গতকাল রাতেই ডায়েরী লিখবো। কিন্তু রাতে যে অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে, তারপর আর লেখার ভাব ছিলো না, তাই রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

গতকাল সন্ধ্যায় পাটোয়ারীর দোকানে আমি চা আর কর্ণিয়া এক বাটি দুধ খেয়ে বাসায় ঢুকে বই পড়ছিলাম! নতুন কোন বই নয়। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা উপন্যাসটি পুনরায় পড়ছিলাম। আসলে বেশীদিন হলেই হয় গল্প নয় গল্পের চরিত্রের নামগুলো ভুলে যাই। আর তাত্ত্বিক বইয়ের কথা নাই বা বললাম। ইদানিং আবার গণিতের ক্যালকুলাস করা উচিত।

আমার স্মৃতিশক্তি প্রখর নয়, তা কিন্তু নয়। সমস্যাটা হলো, আমার গবেষণার বিষয়বস্তু নির্ধারিত করেন আমার মক্কেলরা। তাই একবার গণিত তো আরেকবার সাহিত্য আরেকবার ভৌতিক বিষয়। এত বিষয়ের চাপে মনে রাখাটা একটু মুশকিল।

এবার মূল ঘটনায় আসি। গতকাল রাতে পড়ছিলাম, হঠাৎ দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ। এই ঠকঠক আওয়াজ আমার খুব বিরক্তিকর। কলিং বেল থাকার পরেও ঠকঠক করা লোকগুলো আজব নয়তো বোকা।

দরজা না খুলেই প্রশ্ন করলাম,

— কে?

— আমি?

— আরে আমি টা কে?

— আমি হা করে থাকা সূর্য!

— এটা কেমন হেয়ালী। আপনার নাম কি?

— আমার না হা সান! মানে হা করে থাকা সূর্য!

— কোন হাসান?

— দ্যা মাদার অফ সায়েন্সের শিক্ষক।

মাদার অফ সায়েন্স মানে গণিত। অর্থাৎ গণিতের শিক্ষক হাসান সাহেব দরজায় দাঁড়িয়ে। লোকটা মেঘডুবি উচ্চ বিদ্যালয়ের গনিতের সিনিয়র শিক্ষক। বেশী রসিক লোকটা। আমার সাথে তেমন পরিচয় নেই, শুধু বার কয়েক কুশল বিনিময় হয়েছিলো। এতেই তার মজা করার লেভেল অনেক উঁচুতে।

আমি, ও আচ্ছা! হাসান ভাই। দশ সেকেন্ড।

বলেই দরজা খুললাম। হাসান ভাই বললেন,

— কে ৪০ সের আছেন?

— (বিরক্তির ভাব নিয়ে বললাম) মানে কি?

— ৪০ সের এ মন। তার মানে কেমন আছেন?

— ওহ! ভালো ভালো! তা রাত ১১ টায় হঠাৎ আপনি?

— আমি একা নই। এক জন আপনার সাহায্য চান! তাই তাকে আপনার বাসায় নিয়ে এসেছি।

— তাই বলে এতরাতে!

— উনি বললেন দিনে আসলে সমস্যা আর..

— আচ্ছা বাদ দেন! উনি কে? কই?

আমার ঘরের সামনে একটা বাগান আছে। সেখানে একটি ডালিম গাছ আছে। হাসান ভাই ডান হাতের তর্জনী দিয়ে ডালিম গাছটি দেখিয়ে দিলেন। দেখলাম একজন নারী দাঁড়িয়ে আছেন। নীল শাড়ি পরে আছেন। আমি বললাম,

— উনি কে?

— আমাদের স্কুলের নতুন ম্যাডাম। হেড ম্যাডাম। আপনার কাছে কি একটা সাহায্য দরকার। আপনারা সমস্যা সমাধান করেন আমি পালাই।

— আচ্ছা! উনার নাম কি? ডাকুন উনাকে। ঘরের ভেতর আসতে বলুন।

হাসান ভাই চলে যেতে যেতে বললেন, উনার নাম অবন্তিকা! এবার আপনি উনাকে ডাকবেন নাকি তাড়িয়ে দিবেন তা আপনার ব্যাপার।

আমি একটু চাপা কন্ঠে ডাকলাম,

— মিস বা মিসেস অবন্তিকা! ঘরে আসুন। বসে কথা শুনি!

অবন্তিকা শাড়ির আঁচল গায়ে পেঁচিয়ে আস্তে আস্তে ঘরে আসলো। আমার ঘরে ঢুকতেই দুইটা সোফা আছে। একটা সাদা একটা কালো। যখন কেউ সোফার রঙ খেয়াল করে সোফায় বসে তখন আমি তাদের চারিত্রিক একটা ম্যাপ আঁকার চেষ্টা করি।

অবন্তিকা সোফার রঙ খেয়াল করেননি। তিনি সরাসরি রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে আছেন আমার বিড়াল কর্ণিয়ার চোখাচোখি। ঘরে নতুন কেউ আসলে, কর্ণিয়া প্রথম বিশ মিনিট তাকে পর্যবেক্ষণ করে। তারপর বুঝে শুনে চলাফেরা করে। কিন্তু কর্ণিয়া অবন্তিকার চোখে এক মিনিট তাকানোর পর অবন্তিকা আদুরে গলায় বললো এদিকে আয়।

ব্যস! ওমনিই তিন লাফে কর্ণিয়া গিয়ে বসলো সোফার উপর, অবন্তিকার গা ঘেঁষে।

আমার পড়ার ব্যঘাত ঘটায় একটু বিরক্ত ছিলাম আমি। তার উপর রাত ১১টার বেশী বাজছে। তাই একটু শক্ত গলায় বললাম,

— শুরু করুন আপনার কথা! তার আগে বলে রাখি, গতকাল দুপুরে চিনি শেষ হয়েছে। বাজারে যাইনি বলে আনা হয়নি বলে চা সাধতে পারলাম না। দুঃখিত।

— আমি চা কম খাই! তার উপর আপনি ব্যস্ত মানুষ। বই পড়ছিলেন, আমি বিরক্ত করছি।

— বিরক্ত হচ্ছি, কথাটা সত্য। আমি বই পড়ছি বুঝলেন কি করে?

— হা হা হা হা! বই এখনো আপনার হাতে।

— ওহ! হো। দিনে দিনে যে আমার কি হচ্ছে! যাই হোক, বলে ফেলুন কেন এসেছেন?

— আমি মেঘডুবি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে নিযুক্ত হয়েছি মাস কয়েক হলো।

— অভিনন্দন! তারপর।

— আপনি আমাকে না চিনলেও আমি আপনাকে চিনি। এবং গত পরশু সকালে স্কুলের সামনে দৌড়াতে দেখেছি৷ মানে প্রাতঃভ্রমণ।

— আচ্ছা!

— গতমাসে এক লোকের সাথে বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছেন।

— দাওয়াত দিতে এসছেন?

— না! লোকটাকে আমার পরিবারের কেউই চেনে না। নিজ থেকেই এসেই প্রস্তাব করেছিলো, বাবা ঘন্টা দুয়েক কথা বলেই লোকটাকে পছন্দ করেছে এবং তার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে।

— তো?

— আপনি কি খুব বিরক্ত হচ্ছেন?

— তা কেন হবে? কথাকে চুইংগাম এর মত টেনে লম্বা করছেন! ভালোই তো। চিনি ছাড়া কফি খাবেন?

— হুম খাওয়া যায়। তবে আপনাকেও খেতে হবে।

— আমার খেতে ইচ্ছে না করলে আপনাকেও দিতাম না। আমি আসছি ১ মিনিট।

আমি রান্নাঘরে গিয়ে কফি বানালাম দু কাপ। বেশ কড়া করেই বানিয়েছি। সবাই বলে চা/কফি খেলে ঘুম হয় না। আমার ক্ষেত্রে উল্টো। ঘুম ভালো হয়।

দুহাতে দু কাপ কফি নিয়ে গিয়ে দেখি সোফায় অবন্তিকা নেই। কর্ণিয়াও নেই।

ঘুরে তাকাতেই দেখি, অবন্তিকা কর্ণিয়াকে কোলে নিয়ে আমার পড়ার ঘরে বই দেখছে। আমি একটু কেশে বললাম,

— আমার লাইব্রেরিতে অনুমতি ছাড়া ঢোকা নিষেধ।

— জ্ঞানের দ্বার বন্ধ রাখা অন্যায়, অনুচিত এবং বেমানান।

— তা বিশ্বজোড়া পাঠশালা রেখে আমার লাইব্রেরিতে জ্ঞানের সন্ধান কেন?

অবন্তিকা হাসতে হাসতে বললেন,

— আপনার লাইব্রেরি কি বিশ্বজোড়া পাঠশালার বাইরে নাকি! তাছাড়া আপনার লাইব্রেরির সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো! এখানে এক ধরনের নয়, বহু বিষয়ের বহু ধরনের হাজার বই আছে। বিচিত্রিতা সর্বদাই মানুষকে আকৃষ্ট করে। তা এত ধরনের বই কেন এখানে? সাধারণত মানুষ এক ধরনের বইই পড়ে বা পছন্দ করে। কেউ দ্রোহের, কেউ রোমান্টিকতার, কেউ বিজ্ঞানের, কেউ বা আবেগময় পদ্যের বই।

— আমার পেশাই হলো বই পড়া। আর আপনার লেকচার শেষ হলে কফি খেতে খেতে বাকি কথাগুলো বলে দূর হোন।

— আপনি তো দেখছি যথেষ্ট অভদ্র। শুনেছি গবেষকেরা পাগল হয়। আপনি তো দেখছি অভদ্র।

— তাহলে চলে যান। রাত ১২টার বেশী হয়েছে।

— বাকি কথাগুলো বলেই চলে যাবো।

দুজনের হাতে দু কাপ কফি। আমি কালো সোফায়, অবন্তিকা সাদা সোফায়। অবন্তিকা ডান হাতে কফিতে চুমুক দিয়ে বাম হাতে শাড়ির কুচি ঠিক করতে করতে বললো,

— লোকটার সাথে বিয়ে আগামী মাসের ১১ তারিখ। লোকটা গত সপ্তাহে বাসায় এসে বলে গেছে বিয়েটা করবে, তবে একটা শর্ত আছে! আর তা হলো বিয়ের আগে আমাকে ১৫০টি কবিতা মুখস্ত করে তাকে শোনাতে হবে। তবেই সে আমাকে বিয়ে করবে। নইলে না। এদিকে বিয়ের সবকিছু ঠিকঠাক। আমি কি করে এতগুলো কবিতা মুখস্ত করি বলুন তো!

— আমি পেশায় কি তা আপনি জানেন?

— হুম!

— তাহলে কি কারণে এই অদ্ভুত বানোয়াট গল্প শোনাতে এসেছেন!

— ব্যাপারটা সত্যিই। আপনার কাছে এসেছি দুটি কারণে!

— বলুন।

— প্রথম ব্যাপারটা হলো, আমাকে লোকটার বিস্তারিত সংগ্রহ করে দিন!

— শুনুন আমি গোয়েন্দা বিভাগে লোক না; শার্লক হোমস, সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী কিংবা মানিক বাবু’র ফেলুদা নই। আপনি দূর হোন।

— ফেলুদা তো সত্যজিৎ রায়ের। তা মানিক বাবুটা কে?

— উফফ! সত্যজিৎ রায় মানিক বাবু নামেই পরিচিত ছিলেন। আপনি আসার ২য় কারণটি বলুন।

— দ্বিতীয় কারণ হলো, আমাকে এমন একটা বুদ্ধি দিন যেন আমি এই অল্প সময়ে ১৫০টি কবিতা মুখস্ত করতে পারি। আর তা যদি না পারেন, তা হলে আপনি আমাকে বিয়ে করতে হবে বিনা শর্তে।

— এটা কি মামার বাড়ির আবদার নাকি ছেলের হাতের মোয়া। মাঝ রাতে মজা করার সীমা বহু আগেই ছাড়িয়েছেন। এবার অনুগ্রহপূর্বক বিদায় হোন।

— অবশ্যই। আমি কাল বিকেলে স্কুল শেষ করে আসবো আবার। আপনি ১৫০ টি কবিতা মুখস্ত করার উপায় প্রস্তত করে রাখবেন।

— হুম! আমাকে গরুতে কামড়ালেই তবে রাখবো।

— নীল শাড়িতে আমাকে কেমন লাগছে?

— জঘন্য! এবার শুভ রাত্রি।

অবন্তিকা উঠে আঁচল ঠিক করতে করতে বের হয়ে যাচ্ছে আর বলছে।

— ব্যাপারটা আপনি হালকা করে নিবেন না প্লিজ। লোকটা আমাকে বিয়ে না করলে আমার বাবা ভীষণ কষ্ট পাবেন। যে কোন দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে।

অবন্তিকা ঘর থেকে বের হয়ে, তার ড্রাইভারকে ফোন করলো। আমি পেছন থেকে ডাক দিয়ে বললাম,

— শুনুন!

— বিদায় হচ্ছি তো! ডাকছেন কেন?

— আপনার বাবা কি করেন?

— কিচ্ছু না! তিনি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক ছিলেন। এখন অবসরপ্রাপ্ত।

এই বলে অবন্তিকা গাঢ় নীল গাড়িতে উঠে চলে গেলেন।

আমি কর্ণিয়াকে এক বাটি দুধ দিয়ে বিছানায় শুয়ে ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। বারবার ভাবছি, অবন্তিকার ব্যাপারটা মাথা থেকে সরিয়ে ফেলবো। কিন্তু পারছিনা। আগামীকাল বিকেলে আবার আসবেন অবন্তিকা। ধ্যাৎ! বিরক্তিকর।

ভাবছি, ১৫০ কবিতা কেন? লোকটা কি পাগল? নাকি অবন্তিকা আমার সাথে বাঁদরামো করছে। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না।

এখন প্রায় দুপুর হয়ে এলো। অবন্তিকার ১৫০ কবিতা মুখস্ত করার উপায় খুঁজছি। নাহ! হবে না এখন।

দেখি একটু বিশ্রাম নেই। যা হবার তাই হবে। এত ভেবে লাভ নেই।

হাসান জামান
হাসান জামান
কলেজ জীবনে ২০০৫ সাল থেকে কবিতা আর ছোটগল্প লেখার মধ্য দিয়ে সাহিত্যে পদার্পণ তরুণ লেখক হাসান জামান-এর৷ তারপর জাতীয় দৈনিকসহ লিখেছেন অনেক লিটল ম্যাগজিন-এ৷ এক সময় সম্পাদনা করেছেন এক সময়কার জনপ্রিয় লিটল ম্যাগাজিন "অর্বাচীন" ও "শব্দঘর"৷ পেশায় সফটওয়্যার নির্মাতা ও তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক পরামর্শক হলেও সাহিত্যের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেননি৷ সুযোগ পেলেই সাদা জমিনে কলমের আঁচড়ে সাহিত্য রচনার চেষ্টা করেন অবিরত৷
একইমত আর্টিকেল

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন

- Advertisment -
Digital Marketer Apple Mahmud Riyad

জনপ্রিয়

মন্তব্য