অবন্তিকা-রুদ্রঃ
দুপুরে বিশ্রাম করতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কর্ণিয়া বিছানায় উঠে লাফাচ্ছিলো। তাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল।
ফোনটা বাজছে। নিশ্চয়ই তীরন্দাজ মামা। মামা ছাড়া আমাকে কেউ ফোন করে না। উঠে গিয়ে ফোনটা ধরেই বললাম
— মামা, বলো। কোথায় আছ? কেমন আছ?
— আগের জায়গায় আছি, দারুণ আছি। তুই কি নিয়ে গবেষণা করছিস ইদানিং?
— তেমন কিছুই না। অবসর চলছে।
— আচ্ছা শোন, তোর সাথে দেখা করা প্রয়োজন।
— আমি ফ্রী আছি! কোথায় আছ? কবে যাবো তোমার ওখানে বলো?
— আমি শ্রীমঙ্গলেই আছি। চলে আয় যে কোন সময়।
— আচ্ছা।
— তোর কোন বিদেশী রাইটারের বই লাগবে?
— কেন?
— এখানে এক ইঞ্জিনিয়ার আছে, নরওয়ের। তার কাছে ওরহান পামুকের বেশ কিছু বই আছে। তোর লাগলে আমি রেখে দিবো।
— রেখে দাও। ফোন রাখছি।
— আচ্ছা।
ফোনে বেশীক্ষণ কথা বলতে ভালো লাগে না। কেমন যেন অস্বস্তি লাগে।
কলিং বেল বেজে উঠলো। আমি দরজার দিকে যেতে যেতে বললাম,
— কে?
— আমি। অবন্তিকা।
ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম ৪টা বেজে গেছে। দরজা খুলে দেখলাম অবন্তিকা আর একজন যুবক দাঁড়িয়ে। সুদর্শন আর রুচিশীল। অবন্তিকা আজও নীল শাড়ি পরে এসেছে। আর যুবকের গায়ে মেরুন পাঞ্জাবী। আমি ১০ সেকেন্ড দুজনের দিকে তাকিয়ে থেকে অবন্তিকাকে বললাম
— আপনিতো বিকেলে আসার কথা।
— এখন ও বিকেল।
— মানে স্কুল ছুটির পর।
— উনি আমার স্কুলে গিয়েছিলেন, তাই একটু আগেই স্কুল থেকে বেরিয়ে গেছি।
— আচ্ছা ভেতরে আসুন। আর আপনার তো একা আসার কথা।
— তা তো বলিনি! আমি শুধু বলেছি আসবো।
কালো সোফায় আমি বসেছি আর সাদা সোফায় অবন্তিকা আর যুবকটি।
অবন্তিকা পরিচয় করিয়ে দিলো
— উনি হচ্ছেন মতি মিয়া; পেশায় গবেষক। নেশা বই পড়া। আর ইনি হচ্ছেন রুদ্র। যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।
আমিঃ রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ নাকি!?
রুদ্রঃ না, রুদ্র শেখর।
আমিঃ তা কি করেন আপনি?
রুদ্রঃ ব্যবসা করি।
আমিঃ কিসের ব্যবসা?
রুদ্রঃ শব্দের ব্যবসা।
আমিঃ (হাসতে হাসতে) নাকি শব্দ শ্রমিক?
রুদ্রঃ আপনি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ পড়েছেন দেখছি।
আমিঃ হুম! বহু আগেই।
রুদ্রঃ আচ্ছা, আপনারা গল্প করুন। আমি বের হবো, কাজ আছে।
আমিঃ সেটাই মঙল।
রুদ্রঃ আসছি।
অবন্তিকা এতক্ষণ আমার দিকে একবার, রুদ্রের দিকে একবার তাকাচ্ছিলো। এবার একটু নড়েচড়ে বসেছে। রুদ্র বের হতে গিয়ে কর্ণিয়াকে দেখে বললো
— ওর নাম কি?
— কর্ণিয়া।
— সুন্দর নাম। আমি গেলাম।
রুদ্র বের হয়ে যাবার পর আমি দরজা আটকে অবন্তিকাকে বললাম।
— বলুন।
— পেলেন ১৫০ কবিতা মুখস্ত করার উপায়?
— না! পাগলামি না করে, রুদ্রকে বুঝিয়ে বলেন।
— ও যদি বুঝতে না চায়, আপনি আমাকে বিয়ে করবেন?
— হা হা হা হা! এটা ভুলে যান আপা। আমি রোমান্টিক নই। এবং এটা সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব।
— ধ্যাৎ! তাহলে উপায় বলুন।
— আপনার বাবার সাথে দেখা করা প্রয়োজন। তিনি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন?
— আমার বাবার নাম, মিহির জাহেদ।
— ওহ! আপনি স্যারের মেয়ে! উনি তো অসাধারণ লেখক। উনার ১৭ টি বইই পড়েছি। তাহলে তো স্যারের সাথে দেখা করতেই হয়। আজই যাবো স্যারের সাথে দেখা করতে।
— চলুন।
— আমি রেডি হয়ে আসি।
— মেকাপ করবেন নাকি?
— না। একটা নীল টিশার্ট পরবো।
অবন্তিকার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। আমি একটুখানি হাসি দিয়ে। শোবার ঘরে গিয়ে একটা নীল টিশার্ট পরে ফিরে এলাম।
— বাহ আপনাকে নীল টিশার্ট এ তো দারুন লাগে।
— তাতে আপনার কি?
— আমার আর কি! এমনি বললাম।
— ঠিক আছে চলুন।
আমি কর্ণিয়াকে বারান্দায় রেখে বের হলাম। অবন্তিকা নীল গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটে বসতে বসতে বললো,
— সামনে বসুন। আমার পাশে।
— গাড়ি কি আপনি চালাবেন?
— কেন ভয় করছে? চিন্তা করবেন না। আমার কাছে নিজের চেয়েও আপনার প্রতি মায়া অনেক বেশী। চলুন আমরা বাসায় না গিয়ে লং ড্রাইভে যাই!
— আজ কিন্তু আপনি বেশী বকছেন।
— চলুন না ঘুরে আসি।
আমার কি যেন মনে হলো। বললাম,
— ঠিক আছে, স্যারের সাথে না হয় অন্যদিন দেখা করবো। তবে লং ড্রাইভে নয়। আশেপাশে কোথাও চিনি ছাড়া কফি খাবো।
— এতেই হবে।
— কি হবে?
— কিচ্ছু না! সিট বেল্ট বেঁধে নিন।
আমি সিট বেল্ট বাঁধলাম। গাড়ি চলতে শুরু করলো। কয়েক মিনিট চলার পর অবন্তিকা গুনগুন করে গান গাইছে, সময় গেলে সাধন হবে না… দিন থাকিতে দিনের সাধ……ন।
আমি চিৎকার করে বললাম,
— আর একটা লাইন গাইলেই আমি গাড়ির দরজা খুলে চলন্ত অবস্থায় নেমে যাবো।
— লালন পছন্দ নয় আপনার?
— অবশ্যই পছন্দ। কিন্তু আপনাকে হঠাৎ বিরক্ত লাগছে।
আমি রাগের ভান করলাম যাতে অবন্তিকা একটু হিসেব করে কথা বলে আমার সাথে। ধীরে ধীরে তার সাহস এবং পাগলামী বেড়েই চলেছে।
ঘড়ির কাঁটায় প্রায় সাড়ে পাঁচটা। আমি খুব আদুরে কন্ঠে বললাম,
— শুনুন! এবার কোথাও থেমে কফি খেয়ে নেই।। মেঘডুবি ফেলে এসেছি বহু আগে।
অবন্তিকা আস্তে করে আচ্ছা বলে গাড়িটা একটা ক্যাফের সামনে দাঁড় করালো।
একটি টেবিল; আমি আর অবন্তিকা মুখোমুখি।
দুজনের সামনে দু মগ কফি। হঠাৎ অবন্তিকা বলে উঠলো,
— মনে আছে তো?
— হুম মনে আছে!
— কি মনে আছে?
— ১৫০ টি কবিতা।
— আর?
— আর কি?
— উপায় বের করতে না পারলে আপনি আমাকে বিয়ে করবেন।
— আচ্ছা।
— সত্যিইইই! তাহলে আমি কবিতা মুখস্ত করবো না।
— প্রায় চারশ কবিতা আপনার মুখস্ত আছে। আমি জানি।
— মানে? কে বলেছে আপনাকে?
— তা অন্যকোন দিন বলবো। তবে এটা সত্যিই।
— এখনি বলতে হবে।
— আমি আপনার অধিনস্থ কেউ নই।
— তবুও বলতে হবে!
— এক শর্তে বলবো।
— উফফ! কি শর্ত?
— আমাকে আরেক কাপ কফি খাওয়াতে হবে।
— ঠিক আছে।
অবন্তিকা রেস্টুরেন্টের লোককে ডাকতে যাবে, ঠিক তখনি বললাম।
— এখন আমার কফি খেতে ইচ্ছে করছে না।
— আমার সাথে কি আপনি মজা করছেন! হুহ!
— কাল কফি খাবো।
— আপনি কফি খান বা না খান আপনাকে এখনি বলতে হবে যে, আমি ৪০০ কবিতা মুখস্থ পারি এটা আপনাকে কে বলেছে?
— আমি তো এটাও জানি যে আপনার বিয়ে ঠিক হয়নি। এবং… থাক বাকি কথা কাল হবে। চলুন।
— না আমি যাবো না। আপনি চলে যান।
আমি রাস্তায় বের হলাম, রাস্তা বলতে হাইওয়ে। পেছনে তাকিয়ে রেস্টুরেন্টের গ্লাস দিয়ে দেখলাম অবন্তিকা রাগে কপালে হাত বসে আছে। আমি বিলটাও দিয়ে আসিনি৷ ওয়ালেটটাই আনিনি ইচ্ছে করে।
হায় হায় তাহলে আমি একা ঘরে ফিরবো কি করে! এখান থেকে মেঘডুবি প্রায় ২০ কিলোমিটার। হেঁটে যাবার অবস্থা নেই। হাইওয়ে, তাই এখান থেকে অটো টটো পাওয়াও মুশকিল।
অতঃপর আবার ভেতরে ঢুকলাম। অবন্তিকা আমাকে দেখেই দাঁড়িয়ে গেল আর বললো,
— ফিরে এসেছেন কেন?
— না মানে?
— থাক! সরি টরি বলা লাগবে না।
— আমি সরি বলতে আসিনি?
— তাহলে কি উত্তরটা দিতে এসেছেন?
— না! আমি ওয়ালেট আনিনি। আপনার গাড়িতেই যেতে হবে।
— আমার গাড়িতে যেতে হলে একটা শর্ত আছে।
— কি শর্ত ?
— আমার সাথে আরেক কাপ কফি খেতে হবে।
— আমি চা খাবো।
— ঠিক আছে।
এ বলে অবন্তিকা চায়ের অর্ডার দিলো। দুজন চুপচাপ চায়ে চুমুক দিয়ে চা শেষ করলাম। কোন কথা ছাড়াই দুজন গাড়িতে উঠলাম।
গাড়ি আমার ঘরের সামনে আসতেই আমি গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। পেছন থেকে অবন্তিকা ডেকে বললো, নীল টিশার্ট এ আপনাকে সত্যিই ভালো লাগে।
আমি উত্তরে মুচকি হাসি দিয়ে ঘরে ঢুকলাম। আর অবন্তিকা নীল শাড়ি পরে নীল গাড়ি চালিয়ে সবুজের ভেতর দিয়ে চলে গেল।
ঘরে ঢুকেই কর্ণিয়াকে কোলে নিয়ে শোবার ঘরে গেলাম। কর্ণিয়ার খাবার এখানেই আছে। ওকে খাবার দিয়ে বিছানায় হেলান দিলাম একটি বই হাতে।
বইটার নাম, নীলের কবিতা। একটা উপন্যাস। লিখেছেন মিহির জাহেদ।
মতি মিয়া, ৬ অক্টোবর ২০১৯।