সিলেট গমন ও রুদ্র অপহরণঃ
আজ ৮ অক্টোবর ২০১৯। এখন সময় সকাল দশটা।
গতকাল রাতে উপবন এক্সপ্রেসে ওঠার পর থেকে কিছুই লেখা হয়নি। তার উপর একটু আগে অবন্তিকা ফোন করে বললো, রুদ্র অপহৃত হয়েছে। আমি যেন খুব দ্রুত মেঘডুবিতে যাই।
গতকাল থেকে কি হয়েছে তা লিখে নিই আগে।
ট্রেনে উঠার পর সায়ন্তিকা বসলো জানালার পাশের সিটে আমি তার পাশের সিটে। বসেই আমি ব্যাগে থাকা আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমস সিরিজের উপন্যাস দি হাউন্ড অফ দি বাস্কারভিলস উপন্যাসটি বের করে পড়তে শুরু করলাম। ট্রেন এখনো ছাড়েনি।
কোনান ডয়েল হোমসকে নিয়ে চারটি উপন্যাস ও ছাপ্পান্নটি ছোটগল্প লিখেছেন। কি করে যে পারলেন লিখতে। ডয়েল পেশায় একজন ডাক্তার ছিলেন। শার্লক হোমসের মত এমন চরিত্র নিয়ে এত লেখা সত্যিই বিশাল ব্যাপার। তাছাড়া ডক্টর ওয়াটসনও বা কম কিসে।
উপন্যাসটি পড়ছি। সায়ন্তিকা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। গুনগুন করে গানও গাইছে৷ ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না। বোধ হয় নজরুল সংগীত, খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে।
হঠাৎ একটা বাচ্চা ছেলে সামনে এসে বললো,
— স্যার পেপার নেন একটা।
ছেলেটার বয়স ১২ কি ১৩ হবে। ছেলেটাকে দেখেই সুমনের পেটকাটি চাঁদিয়াল গানটা মনে পড়ে গেল।
“বয়স বারো কি তেরো, রিকশা চালাচ্ছে,
আকাশে ঘুড়ির ঝাঁক ছেলেটাকে ডাকছে।
বয়স বারো কি তেরো, বড়জোর চোদ্দ,
রিক্শা চালাতে শিখে নিয়েছে সে সদ্য।
ছেলেটার মন নেই প্যাডেলে বা চাক্কায়,
ঐ তো লেগেছে প্যাঁচ চাঁদিয়াল বগ্গায়।”
ছেলেটাকে নরম সুরে, হাসতে হাসতে বললাম,
— এই যুগে মানুষ পেপার পড়ে? তাও আবার এই রাত ১০টায়!
— পড়ে না ক্যান?
— ওই যে মোবাইল ইন্টারনেট। ওইটা দিয়েই সব পড়ে ফেলে মানুষ। ভালো মন্দ।
— এই জন্যেই তো আমাগো পেপার বেচা হয় না।
— আমি পেপার নিবো না। তোরে এমনি ১০০ টাকা দেই?
— এমনিই দিবেন?
— হুম! আমি পেপার পড়ি না।
— আইচ্ছা দেন।
আমি পকেট থেকে ১০০ টাকা বের করতে গিয়ে মনে পড়লো অবন্তিকার চেক ভাঙ্গানো হয়নি। মানে ক্যাশ করা হয়নি। যদিও আমার কাছে যথেষ্ট আছে।
ছেলেটাকে ১০০ টাকা দিয়ে বললাম,
— এমনি দিলে তোর অভ্যেস খারাপ হয়ে যাবে। একটা পেপার দিয়ে যা।
ছেলেটি ১০০ টাকা হাতে নিয়ে আমাকে একটা পেপার দিয়ে হাসতে হাসতে বললো,
— একটা পেপারের দাম ১০০ টাকা দিলেন। এহনতো অভ্যেস আরো খারাপ হইয়া যাইবো।
ছেলেটা চলে গেল। আমি পেপারিটা ভাঁজ করে রেখে দিলাম। আমি পেপার সহজে পড়ি না। আর পড়লেও বাসি পেপার পড়ি মানে পুরানো পেপার পড়ি। এখনকার পেপার জুড়ে শুধু খুন-জখম-হানাহানি-দূর্নীতি এসবে ভরা। অবশ্য মানুষজন এগুলো পড়ে আহা উহু করে আফসোস করতে পছন্দ করে। আর আফসোস শেষ আলোচনা, সমালোচনা। শেষ কয়েকটা বছরের বহুল প্রচারিত সংবাদগুলোর প্রায় শতকরা ৯০ ভাগই খুন, হামলা, জখম। এগুলো খুব দ্রুত মানুষের দৃষ্টিগোচর হয়। ভালো কাজ যা হয়নি বা হয় না; তা কিন্তু নয়। সেগুলো তো আর বহুল প্রচার হয় না। মানুষ দুঃখ বিলাসী।
আবার শার্লক হোমসে মনোযোগ দিলাম। ট্র্বেন ছেড়েছে। আমার কাছে ঝড়ের বাতাসের শব্দ, টিনের চালের শব্দ আর ট্রেনের শব্দ পৃথিবীর শ্রুতি মধুর শব্দগুলো অন্যতম মনে হয়।
ট্রেন ছুটছে। সায়ন্তিকা পাশে বসে আছে। আমি বই পড়ছি।
হঠাৎ সায়ন্তিকা বলে উঠলো,
— আচ্ছা আপনি কি করে বুঝলেন যে আমি অবন্তিকার বোন?
— আপনি তো বোকা দেখছি। নীল গাড়িটা দেখেই চিনেছি। ওই গাড়ি করেই অবন্তিকা প্রায়ই সময় আমার কাছে আসতো। তা আপনি কেন আমার কাছে এসেছেন?
— অবন্তিকা কেন আসতো? এটা জানতে।
— তা তো বলা যাবে না বাপু। এটা সিক্রেট।
— শুধু এতটুকু বলুন যে, রুদ্র আর রুদ্রের করা খুনের ব্যাপারে কিনা?
— হুম। আপনি জানেন সব?
— হ্যাঁ। আপনি দয়া করে আমাকে তুমি করে বলুন। আমি আপনার ঢের ছোট বয়সে।
— একবার তো তুমি করে বলেছিলাম, সাথে সাথেই তো আমাকে তুমি করে ডেকে প্রতিশোধ নিয়ে নিলেন। এখন নিজেই বলছেন…
— মানুষ মরে গেলে পঁচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়; কারণে অকারণে বদলায়।
— তা আপনি কি কারণে বদলেছেন নাকি অকারণে?
— আমাকে তুমি করে বলুন।
— ঠিকাছে। এবার বলুনতো আপনি রুদ্রের ব্যাপারে কি জানেন?
— কিচ্ছু না। শুধু জানি। রুদ্র একটি খুন করেছেন এবং তা অবন্তিকা আপুর জন্যে।
— কি করে জানলেন?
— বাবা বলেছেন।
— উনি কি করে জানলেন?
— উনাকে বোধহয় রুদ্রই বলেছেন। রুদ্র বাবা খুব প্রিয় ছাত্র ছিলো। বাবা রুদ্রকে অনেক পছন্দ করেন, আর রুদ্র অবন্তিকা আপুকে।
— হুম বুঝলাম।
— কি বুঝলেন?
— আপনার বাবা বলেনি রুদ্র কাকে খুন করেছে?
— নামটা বলেছে। লেওনার্ড অয়লার।
— ধ্যাৎ। আপনার বাবা আপনার সাথে মশকরা করেছেন।
— না। এটাই সত্যি।
— আরে অয়লার তো ১৭০৭ সালে সুইজারল্যান্ডে জন্ম নেয়া একজন গণিতজ্ঞ এবং পদার্থ বিজ্ঞানী।
— জানি।
— তাহলে কি কোন বিদেশী ছেলে? নাকি কারো ছদ্মনাম।
— বিদেশী নয়, ছদ্মনামও নয়।
— একজন বাঙ্গালীর নাম এমন হয়। তাও আবার সত্যিকারের নাম?
— হুম। বাবা তো তাই বললেন।
— আচ্ছা আপাতত বাদ দিন। আপনি ঘুমান আমি বই পড়ি।
সায়ন্তিকা কোন কথা না বলে জানালায় চোখ দিয়ে আকিয়ে থাকলো। আমিও বই নিয়ে মনোযোগ দিলাম।
পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ সায়ন্তিকার ডাকে ঘুম ভাঙলো। আমি চোখটা আধো খুলে বললাম,
— কি হয়েছে?
— ক্ষুধা লেগেছে।
আমি উঠে মুখ ধুয়ে, খাবারের বগি খুঁজে খাবার নিয়ে আসলাম। সায়ন্তিকার হাতে দিয়েই আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।
আবার সায়ন্তিকা ডাকতে শুরু করলো।
— মতি ভাই। ও মতি ভাই।
— কি হয়েছে? সমস্যা কি? মাত্রই তো খাবার এনে দিলাম। এখন আবার কি?
— মাত্রই না! কয়েক ঘন্টা হয়ে গেছে। উঠুন আমরা পৌঁছে গেছি।
— ও আচ্ছা।
এ বলে বইটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রেডি হয়ে গেলাম। আমরা শ্রীমঙ্গলে চলে এসেছি।
ট্রেন থেকে নেমে দুজনে সোজা চলে গেলাম টি হেভেন রিসোর্টে। এখানে বহু আগে টানা ৭৫ দিন ছিলাম। মাঝে কয়েকদিন তীরন্দাজ মামাও ছিলেন আমার সাথে। এক গবেষণার কাজে চা বোর্ডের কর্মকর্তা বোরহান সাহেব আমাকে আমন্ত্রণ করেছিলেন। এরপর আর আসা হয়নি এখানে।
আমাকে আর সায়ন্তিকাকে দেখেই ম্যানাজার মকবুল সাহেব বসা থেকে উঠে বললেন,
— আরে মতি ভাই যে। অনেকদিন পর আসলেন। কেমন আছেন?
— মকবুল ভাই, আপনি এখনো এই রিসোর্টে আছেন দেখছি।
— আর কই যাবো। এটাই তো ভালো যায়গা। তা সাথে কি ভাবী নাকি?
— হুম ভাবী। তবে ভাইটা আমি না। কে? তাও জানি না।
— আপনি আগের মতই আছেন মতি ভাইই।
— রুম দেন। আমাকে ছায়াবৃক্ষ আর ম্যাডামকে ক্যামেলিয়া।
মকবুল চাবি নিয়ে আমাকে ছায়াবৃক্ষ রুমটি খুলে দিলো আর সায়ন্তিকাকে ক্যামেলিয়া রুম।
আমি রুমে ঢুকে স্নান করে জামা কাপড় বদলালাম। ব্যাগ থেকে জামা কাপড় বের করবো এমন সময় ফোন বেজ উঠলো। অবন্তিকা ফোন করেছে।
— হ্যালো অবন্তিকা বলুন।
— দুটো বিপদ।
— নাম্বার ওয়ান?
— রুদ্র কিডন্যাপড।
— নাম্বার টু?
— আমার ছোট বোন বিউটিকে পাওয়া যাচ্ছে না।
— বিউটি আমার সাথে আছে।
— মানে? কি বলছেন উল্টোপাল্টা!
— সেসব পরে বলবো। আপনি বলুন তো রুদ্র কিডন্যাপড কি করে জানলেন।
— একটা চিরকুট পাওয়া গেছে ওর বাসার জানালায়।
— কি লেখা তাতে?
— একটা ম্যাথ লেখা। আর লেখা, রুদ্র কিডন্যাপড। আপনি কোথায়? বিউটি কোথায়?
— আমরা শ্রীমঙ্গলে।
— মানে কি? বিউটি কোত্থেকে আপনার সাথে। ও তো বান্দরবান যাওয়ার কথা।
— সেসব দেখা হলে বলবো।
— আপনারা প্লিজ তাড়াতাড়ি চলে আসুন।
— আমি দেখছি। আপনি চিন্তা করবেন না। রাখছি।
হঠাৎ দরজায় নক।
— কে?
— আমি সায়ন্তিকা। আপনি খেতে যাবেন না?
— না! আপনি খেয়ে নিন।
সায়ন্তিকা কথা না বাড়িয়ে চলে গেল। আমি এই যে ডায়রী লিখছি। লেখা শেষ হলে লম্বা হয়ে একটা ঘুম দিবো। তারপর বাকি কাজ।
রাতে আবার ডায়েরী লিখবো। এর মধ্যে রুদ্রের খবর জানলে ডায়েরীতে লিখে রাখবো।
মতি মিয়া, ৮ অক্টোবর ২০১৯।