26 C
Dhaka
হোম সিরিজথ্রিলার সিরিজমতি মিয়ার ডায়রী | পর্ব ৭

মতি মিয়ার ডায়রী | পর্ব ৭

চন্দ্রাবতী এবং তীরন্দাজ মামাঃ

সকালে ডায়রী লিখে লম্বা হয়ে শুয়ে ঘুম দিয়েছিলাম। হঠাৎ দরজায় নক শুনে লাফ দিয়ে উঠি। দরজা খুলে দেখি সায়ান্তিকা। ঘুম চোখে জড়ানো কন্ঠে বললাম,
— কি লাগবে বলুন?
— খাবেন না?
— কি? লাঞ্চ নাকি ডিনার?
— এখম দুপুর ২ টা বেজে ৩৭ মিনিট, তারমানে এখন লাঞ্চের সময়।
— ও আচ্ছা। আপনি ডাইনিং এ যান, আমি আসছি।

আমি হাত মুখ ধুয়ে ঠিকঠাক মতো ডাইনিংএ চলে গেলাম। সায়ন্তিকা বসে আছে। আমি ওর উল্টো দিকের চেয়ারে বসতে বসতে বললাম, খাবার অর্ডার করেছেন?
— আপনি না আসলে কিভাবে করি? আপনি কি খাবেন আমি কি জানি?
— আমি সর্বভূক। সবকিছু খাই।
— মতি ভাই, এখানে সর্বভুক বলে কিছু নেই। স্পেসিফিক কিছু বলতে হবে।
— যে কোন মাছ।

সায়ন্তিকা আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে ওয়েটারকে ডেকে অর্ডার করলো। আমি জানালা দিয়ে আকাশ দেখছিলাম।
— আচ্ছা মতি ভাই আপনি কখনো ডাক্তার দেখননি?
— কেন? কিসের ডাক্তার দেখাবো?
— এই যে আপনার মানসিক সমস্যা আছে। আপনি একটা পাগল; এটা আপনি বোঝেন না?
— বোকা মেয়ে আপনি। শুনুন, পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষই পাগল। কেউ কম, কেউ বেশী; কেউ প্রকাশ্যে, কেউ গোপনে। আমিও পাগল।

কথা শেষ করতেই দেখলাম, পাশের টেবিলে একটা মেয়ে একা বসে আছে৷ এক হাতে মোবাইল ফোন, আরেক হাতে একটা ছোট্ট ব্যাগ। আমি মেয়েটার সামনে গিয়ে বললাম,
— আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছে? কিন্তু চিনতে পারছিনা। আপনার নামটা বলুনতো।
— আমার নাম আকাশ ভরা সূর্য তারা। চিনেছেন? চিনেননি তো। সুতরাং নিজের টেবিলে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করুন।
— ও আচ্ছা! আসলে ইদানিং সর্বত্র ভুল হচ্ছে আমার, বয়স বাড়ছে তো তাই বোধহয়। দুঃখিত বিরক্ত করলাম।
— আপনি আপনার টেবিলে যান। আমি আসছি আপনার টেবিলে।
— আপনি আমাকে চিনলেন না। তাহলে আমার টেবিলে কেন আসবেন?
— আপনি যান। আমি আসছি।

আমি আমার টেবিলে চলে আসলাম। সায়ন্তিকা আমাকে বললো,
— কে উনি?
— চেনা চেনা লাগছিলো তাই পরিচয় জানতে চাইলাম।
— হ্যাঁ! তাই তো। পৃথিবীর সবমেয়েই আপনার পরিচিত। সমস্যা কি আপনার?
— আমার সমস্যা হলো আমার কাছে “মেয়ে” এর চেয়ে মানুষ পরিচয়টা গুরুত্বপূর্ণ আর আপনাদের কাছে উল্টো।

পাশের টেবিলের মেয়েটা ফোনে কথা শেষ করে আমাদের টেবিলে সায়ন্তিকার পাশে বসে বললো,
— আপনার এসব ঢং কিংবা পাগলামি এখনো যায় নি?
— আপনার পরিচয়টা তো আগে দিন। আমি তো আপনাকে চিনতেই পারছি না৷
— আপনার স্মরণশক্তি খুব প্রখর আমি জানি। আপনি আমাকে চিনেছেন তাও বুঝতে পারছি। এবার ঠিকঠাক করে আমার পরিচয়টা আপনিই বলুনতো।
— ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আপনি চন্দ্রাবতী; বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি। বছর কয়েক আগে একটা কনফারেন্সে আলাপ হয়েছিলো আপনার সাথে। কেমন আছেন?
— ভালো। তা এতক্ষণ ঢং করছিলেন কেন?
— না মানে।

বছর কয়েক আগে একটা কনফারেন্সে চন্দ্রাবতীর সাথে আমার আলাপ হয়েছিলো মাত্র ৩ মিনিট ৪৪ সেকেন্ড। ওই এক আলাপে আমি চন্দ্রাবতীর প্রেমে পড়েছিলাম। চন্দ্রাবতী খুব গম্ভীর থাকে কিংবা তাকে গম্ভীর দেখায়, তাই সেদিন কিছুই বলা হয়নি। অবশ্য বলেও লাভ হতো না। তাই বলিনি।

এরপর তাকে একবার দেখার জন্যে বহু খুঁজেছি। পাইনি। অথচ এখন পেলাম যখন আমার প্রেমের কোন ইচ্ছে নেই। তবে হ্যাঁ, মোহটা রয়ে গেছে এখনো। তাই তাকে দেখে নক না করে পারলাম না।

— কি ভাবছেন এতো।
— না তো কিছু না। আপনিতো বাইরের খাবার খান না সচরাচর। তা বাসায় খেয়ে এসেছেন? এখন কি লেমন মিন্ট খাবেন?
— আপনার তো সবকিছুই মনে আছে! হুম লেমন মিন্ট।

সায়ন্তিকা গালে হাত দিয়ে আমাদের কথা শুনছে খুব মনোযোগ দিয়ে। চন্দ্রাবতী ব্যাগ থেকে প্রায় গোলাকৃতির, হালকা গোলাপী রঙের ফ্রেমের চশমা বের করে চোখে পরে নিলো। আমি বললাম,

— কি ব্যাপার আপনার চশমার পাওয়ার আরো বেড়েছে মনে হচ্ছে।
— হুম।
— আগে মাইনাস টু পয়েন্ট ছিলো। এখন কত?
— মাইনাস টু পয়েন্ট ফাইভ।
— ওহহো! শুনুন মাইনাস থ্রী ক্রস করলে কিন্তু চোখ আর ভালো হবে না। নিয়মিত চশমা পরে থাকবেন। আর আপনার বাবা কি এখন এখানে পোস্টিং?
— জ্বী।

এবার প্রথমবারের মতো স্বপ্রণোদিত হাসি দিয়ে বললো,
— আপনি কি হানিমুন করতে এসেছেন? নাকি কাজে?

এ প্রশ্ন শুনে সায়ন্তিকা হো হো করে হেঁসে উঠে বললো,
— মতি ভাইয়ের হানিমুন যেদিন হবে তারপর দিনই কেয়ামত হবে। এতটা বোরিং মানুষ আমি দেখিনি জীবনে।

চন্দ্রাবতী, সায়ন্তিকার “মতি ভাই” শুনে বুঝলো যে সায়ন্তিকা আমার স্ত্রী কিংবা তেমন কেউ নয়৷

চন্দ্রাবতীর সবচেয়ে চমৎকার ব্যাপার হলো, সে কারো সাথে কথা বলার সময় সরাসরি চোখের আইরিশের দিকে তাকিয়ে কথা বলে এবং কথা শেষ হবার আগ পর্যন্ত অন্যকোনদিকে তাকায় না।

আমি একটু জোরে কাশি দিয়ে সায়ন্তিকার হাসি থামিয়ে বললাম,
— থামো। এটা ডাইনিং। এতো জোরে হাসছো কেন?

সায়ন্তিকা কোৎ করে হাসি গিলে ফেললো। সরাসরি চোখে তাকিয়ে চন্দ্রাবতী বললো,
— হাসলে আপনার সমস্যা কি? যাই হোক, কি কাজে এসছেন বলুন! শুনে ধন্য হই।

চন্দ্রাবতী হাসছে, মুচকি হাসছে। আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। একেবারেই অযথা। জানি আমাদের এক হওয়া হবে না কখনো। সম্ভব না। আমি প্রেমপালন করতে পারি না৷

চন্দ্রাবতীঃ বলুন মতি ভাই।
— উফ! এতো মতি ভাই মতি ভাই করছেন কেন?
— সরি মতি আঙেল।

এক সাথে সায়ন্তিকা আর চন্দ্রাবতী হেসে উঠলো। আমি একটু রাগের ভঙ্গিতে বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। হাসি মুখে চন্দ্রাবতীকে বললাম,

— আমি এসেছি এখানে পাহাড়ে গহীনে একটা ঘর বানাতে। সেখানেই থাকবো। আর ফলমূলেই জীবকা হবে।
— তাহলে তো ভালোই হলো।
— কেন?
— আমি বাড়িতে না বলে এখানে এসেছি।
— কেন? বিয়ে ঠিক হয়েছে, কিন্তু পাত্র পছন্দ হয়নি। এমন কিছু?
— হা হা হা হা! আমার বিয়ে ঢের বাকি। সম্ভত আপনার বিয়ের এক মাস পর।
— আমি তো বিয়েই করবো না।
— তাহলে কি আর করা। আচ্ছা আমি যাই।
— যাবেন কেন? লেমন মিন্টটা আসুক।
— আজকেরটা আপনিই খান।

এ বলে চন্দ্রাবতী চলে যাচ্ছিলো। হঠাৎ ফিরে এসে বললো,
— আচ্ছা শুনুন, কবিতা নিয়ে আপনার গবেষণা কতদূর?
— চর্যাপদ পর্যন্ত।
— আমি কবিতায় মনোযোগ দিয়েছি। প্রয়োজন হলে এবং আমার শীতনিদ্রার বিরতি চললে ফোন করবো।
— আপনি আমার চেয়ে বেশীই জানেন। আশা করছি ফোন করা লাগবে না। তবে মাঝে ফোন করে আড্ডা দেয়ার জায়গা নির্ধারণ করে দেখা করতে পারি। আমি বেশীক্ষণ কথা বলতে পারি না ফোনে।
— তা দেখা যাবে।

চন্দ্রাবতী একটা কাগজে তার ফোন নাম্বার লিখে দিলো। আমি বললাম, আমারটা আমি ফোন করে জানাবো। চন্দ্রাবতী বললো, আপনার মনে থাকলেই হয়। গেলাম।

এতক্ষণ সায়ন্তিকা চুপচাপ গালে হাত দিয়ে বসে ছিলো। এবার আমাকে খুব ঢং করে বললো,
— আহা! কি আহ্লাদি আপনি। আমি তো দূরস্থান, অন্য কারো সাথে এভাবে আহ্লাদিত হয়ে কথা বলতে তো কখনো দেখিনি। কাহিনীটা কি?
— কাহিনী টাহিনী পরে হবে! তার আগে বলো যে, তুমি তোমার বাসায় না বলে এসেছ কেন?
— এমনিই। আপুকে টেনশনে রাখার জন্যে।
— কেন?
— আমি আপুকে অনেকবার জিজ্ঞাস করেছি যে সে কোথায় যায়? আপনার কাছে সে এসেছিলো তা বেমালুম লুকিয়ে রেখেছিলো, তাই একটু শোধ নিচ্ছি।

ফোনটা হাতে নিয়েছি চন্দ্রাবতীকে ফোন করে আমার ফোন নাম্বারটা জানবো বলে। নইলে পরে ভুলে যেতে পারি। ফোন বের করে দেখি অবন্তিকা ফোন করেছে ১৮ বার। আমি শুনতেই পাইনি।

সাথে সাথেই অবন্তিকাকে ফোন করলাম।

— হ্যালো! অবন্তিকা, আপনি আমাকে ফোন করেছিলেন অনেকবার। আমি শুনতে পাইনি।
— শুনবেন কেন? আপনার কান তো সিলেটে আর ফোন বরিশালে। আপনারা রওনা দিয়েছেন?
— না! দেখি আজ রাতে রওনা দিতে পারি কিনা!
— দেখি মানে? একটা জলজ্যান্ত মানুষ কিডন্যাপ হয়ে গেছে আর আপনি নিশ্চিন্তে সিলেটে ঘুরছেন! উফফ! আপনারা আজ রাতেই রওনা দিবেন। বুঝতে পেরেছেন।
— হুম! আচ্ছা।

বলেই আমি ফোন কেটে দিলাম। সায়ন্তিকা আমার দিকে বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। আমি কোন পাত্তা না দিয়ে বললাম,
— আজ রাতে আমরা রওনা দিচ্ছি মেঘডুবি’র উদ্দেশ্যে।
— কেন? না, আমি যাবো না। আর আপনি কি আপুকে বলে দিয়েছেন যে আমি এখানে?
— হুম!
— কেন?
— এমনিই। ইচ্ছে হয়েছে তাই।

আমাদের দুপুরের খাবার পর্বে এতকিছু হবে তা বুঝতে পারনি। চন্দ্রাবতীর মুখখানা এখনো চোখে ভাসছ্র। তার মানে কি প্রেমটা আবার জেগে উঠছে? নাহ! সম্ভব না।

এদিকে তীরন্দাজ মামা এখনো ফোন করেনি। উনি নিজে থেকে অন্যের ফোন থেকে কাউকে ফোন না করা পর্যন্ত উনাকে পাওয়া খুব মুশকিল।

শেষ বিকেলে বসে আছি। মকবুল ভাইয়ের সাথে এটা সেটা গল্প করছিলাম। সায়ন্তিকা এসে বললো,
— আজ রাতে আমরা চলে যাবো এটা শিউর?
— হুম!
— তাহলে চলুন ঘুরে আসি বাইর থেকে।
— আচ্ছা।

সায়ন্তিকার সাজুগুজু দেখেই মনে হচ্ছে, সে ঘোরার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে।

পুরো সিলেট বিভাগ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের অন্যতম লীলাভূমি, এটা নিঃসন্দেহে শতভাগ সত্য। কিন্তু এখানে আমি এতো ঘুরেছি যে, দেখার কিছুই বাকি রইলো না। তবুও বের হলাম।

একটা ঢালু রাস্তা দিয়ে হাঁটছি আমরা দুজন। হঠাৎ দেখলাম একটা মাচার উপর থেকে একটা লোক আমার নাম ধরে তুই বলে ডাকছে নাকি সুরে। আমি দূর থেকে চোখ কুঁচকে লোকটা চেনার চেষ্টা করছি।

আমি আর সায়ন্তিকা লোকটার দিকে এগিয়ে যেতেই চিনতে পারলাম। লোকটা আর কেউ নয়, তীরন্দাজ মামা। মামার কাছে যেতেই দেখলাম তার পাশেই বসে আছে চন্দ্রাবতী আর একটা অপরিচিত ছেলে। আমাকে কাছ থেকে দেখেই ছেলেটা দাঁড়িয়ে বললো,
— স্যার কেমন আছেন?

আমি একটু ভাব টাব নিয়ে বললাম,
— হুম ভালো। তোমার কি খবর? বহুদিন পর দেখলাম তোমাকে।
— স্যার আমি ভালো আছি। স্যার এর আগে আপনি আমাকে কখনো দেখেননি।

আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেতে গিয়েও স্থির হয়ে বললাম,
— কখন যে কে কাকে কোথায় দেখেছিলো, দেখে কিংবা দেখবে, তা কি সবসময় বলা যায় নাকি! তোমার সাথে এর আগে দেখা হয়ছে কিন্তু পরিচয় হয়নি। এমনতো হতেই পারে।
— জ্বী স্যার।

তীরন্দাজ মামা আমাকে ডেকে কাছে বসতে বললো।
— বেশী পন্ডিতি না করে এদিকে এসে বস।

মামা আমাকে ডেকেছে দেখে চন্দ্রাবতী বললো,
— এই গবেষককে আপনি চিনেন?
— হুম। চিনবো না কেন? ও আমার ভাগ্নে। তিন খুনের আসামী। পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এখানে পাহাড়ে পালিয়ে থাকতে এসেছে।
— কি বলছেন! তার মানে উনি এখানে এসেছেন ঘর বানিয়ে থাকতে আর ফলমূল খেয়ে বাঁচতে?
— হ্যাঁ।

এবার চন্দ্রাবতী ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি চোখ বড়বড় করে মাস্তান টাইপ চেহারা করার চেষ্টা করছিলাম। এমন চেহারা দেখে চন্দ্রাবতী হেসে উঠলো। অট্টহাসি। তারপর হাসি একটু থামিয়ে বললো,
— নাহ! চেহারা খুনি খুনি লাগছে না। গালে একটা কাটা দাগ করে দিবো নাকি।

আমি কথা ঘুরানোর জন্যে বললাম,
— মামা, এই পুচকে ছেলেটা কে? আমাকে বস না ডেকে স্যার ডাকছে?
— এ হলো আমার শিষ্য সালমান। নায়ক সালমান শাহ বা সালমান খান ভেবে ভুল করা নিষেধ।

এসব কিছু সায়ন্তিকার মাথায় ঢুকছে না। সে মামাকে বললো,
— আপনি কি সাধু, ফকির, দরবেশ, পীর নাকি? এটা কি আপনার আখড়া? একটি মাত্র শিষ্য কেন?
— সংখ্যাতে সবকিছু হয় নাকিরে পাগলি! সংখ্যার চেয়ে গুণগত মানটাই আসল। যেমন ধর পঞ্চাশজন নির্বোধ তোকে মন্দ বললো আর একজন বুদ্ধিমান লোক তোর পক্ষে অবস্থান নিয়ে বললো তুই ভালো। তুই কার কথা বিশ্বাস করবি?
— অবশ্যই বুদ্ধিমান লোকের কথা।
— অথচ গণতন্ত্র মানবে ওই পঞ্চাশজন নির্বোধের কথা। এজন্যেই মূর্খের দেশের গণতন্ত্র প্রয়োগ বৃথা ও বোকামী।
— ঠিক বলেছেন। মামা আমার ভাল্লাগছে না। আজ রাতে মেঘডুবিতে রওনা দিবো। এখন গিয়ে সব গুছিয়ে নিলে ভালো হয়। আমি রিসোর্টে গেলাম।

আমি বললাম, এখনো অনেক সময় পরে গিয়েও গুছিয়ে নিতে পারবে। তাছাড়া একা যাবে কি করে?
চন্দ্রাবতী বললো, আমি ওদিকেই যাবো। উনাকে নামিয়ে দিবো। চলুন।

কোন কথা ছাড়াই সায়ন্তিকা আর চন্দ্রাবতী হেঁটে গেলো। একটু সামনে গিয়ে তারা একটা ছাই রঙ এর গাড়িতে উঠলো। এটা বোধহয় চন্দ্রাবতীর গাড়ি। গাড়িটা শাঁই শাঁই করে চলে গেল। মামার শিষ্য সালমানকে মামা বললো,
— তুমি যাও। বিশ্রাম করো। আর শোনো, আমিষ খাবা না আগামী তিনদিন।

সালমান বাধ্য ছেলের মতো চুপচাপ ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলে চলে গেল। সালমানের পোশাক এতক্ষণ আমার চোখে পড়েনি। সে চা গায়ে একটা কালো কোট পরেছে, ভেতরে লাল টিশার্ট। আর পরনে লুঙ্গী।

সবাই চলে গেল। আমি আর তীরন্দাজ মামা বসে আছি মাচায়। দুজন দুজনের দিকে না তাকিয়ে, আমি তাকিয়ে আছি দূরের এক টুকরা মেঘের দিকে। আর মামা তাকিয়ে আছে কোথায় তা জানি না।

প্রায় ১০ মিনিট পর আমি নীরবতা ভেঙ্গে বললাম,
— তুমি চন্দ্রাবতীকে চেন কি করে?
— একটি আগেই পরিচয় হলো।
— কিভাবে?
— আমি গান গাইছিলাম এখানে বসে, গানের কথার ভুল ধরতে এসেছিলো।
— ওহ! আমি কি করে চিনি তা জিজ্ঞেস করবা না?
— না! এতো জেনে কি হবে! তা টি হেভেন রিসোর্ট কেমন লাগছে এবার?
— তুমি কি করে জানো যে আমরা টি হেভেনে উঠেছি?
— দুপুরে মকবুলের সাথে দেখা হয়েছিলো। ও বললো।
— তাহলে ফোন করলা না যে?
— মনে হচ্ছিলো এমনিই দেখা হবে৷ তাই ফোন করিনি। তাছাড়া সালমানকে বুদ্ধি দিচ্ছিলাম।
— সালমান কি করে?
— প্রথমবার ফলিত পদার্থ বিজ্ঞানে দ্বিতীয়বার ফলিত গণিতে স্নাতক করেছে, আন্তর্জাতিক শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ে মাস্টার্স করেছে এখন পিএইচডি করছে। আর একটা টপিক নিয়ে খুব ভাবছে। টপিকটা খুব ইন্টারেস্টিং। তা হলো, রিসার্চ অন রিসার্চ মেথডোলজি অফ আনএডুকেটেড পিপলস।
— দুইটা স্নাতক, একটা মাস্টার্স আর পিএইচডি’র ছাত্র। এতবড় জ্ঞানী ছেলে আমারে স্যার ডাকলো কেন?
— মনে আছে তুই একবার বলেছিলি যে একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ক্লাস নিয়েছিলি, “ম্যাথ ম্যাজিক ম্যাথমেটিশিয়ান” এর উপর।
— হ্যাঁ! ইউনিভার্সিটি অফ লিভিং আর্ট এর ক্লাস নিয়েছিলাম। তো?
— সালমান তার এক বন্ধুর কাছে সেই ক্লাসের ভিডিও দেখেছিলো। তারপর থেকেই তুই ওর স্যার হয়ে গেলি।

বলেই মামা হা হা হা করে বার কয়েকবার হাসলো। হঠাৎ হাসি থামিয়ে বললো,
— তুই কি চন্দ্রাবতীকে ভালোবাসিস?
— বাসতাম। এখন শুধু মোহটাই আছে। তাছাড়া আমার পক্ষে সম্ভবও না। ইচ্ছেও নেই। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে ও আমাকে ভালোবাসে না। বাসবেও না। কোন প্রকার সম্ভাবনাও নাই।
— এখনো প্রেমটাই আছে। তোর চোখ বলছে। কে তোকে ভালোবাসবে বা বাসবে না, তা জেনে তোর কি দরকার।
— আচ্ছা।

আমি মামাকে অবন্তিকা, রুদ্র ও সায়ন্তিকার হালনাগাদ সব ঘটনা খুলে বললাম। মামা বললো,
— তুই আজকে রাতেই মেঘডুবি রওনা দে। আর গিয়েই অপহরণকারীদের দেয়া চিঠিটা আমাকে পাঠাবি। এখন যা ভাগ। আর শোন রাতে সালমান তোকে ওরহান পামুকের কিছু বই দিয়ে আসবে। যা রিসোর্টে যা।
— আচ্ছা

আমি রিসোর্টে এসে সোজা রুমে ঢুকেছি। সায়ন্তিকার খবর নেয়া হয়নি। আমি আমার রুমে ঢুকে শাওয়ার নিলাম। তারপর এই যে ডায়রী লিখে যাচ্ছি।

দরজায় কে যেন টোকা দিচ্ছে। মেঘডুবি রওনা দিবো রাতে। সেসব বিবরণ পরে সময় করে লিখবো ডায়রীতে।

মতি মিয়া, ৮ অক্টোবর ২০১৯।

হাসান জামান
হাসান জামান
কলেজ জীবনে ২০০৫ সাল থেকে কবিতা আর ছোটগল্প লেখার মধ্য দিয়ে সাহিত্যে পদার্পণ তরুণ লেখক হাসান জামান-এর৷ তারপর জাতীয় দৈনিকসহ লিখেছেন অনেক লিটল ম্যাগজিন-এ৷ এক সময় সম্পাদনা করেছেন এক সময়কার জনপ্রিয় লিটল ম্যাগাজিন "অর্বাচীন" ও "শব্দঘর"৷ পেশায় সফটওয়্যার নির্মাতা ও তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক পরামর্শক হলেও সাহিত্যের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেননি৷ সুযোগ পেলেই সাদা জমিনে কলমের আঁচড়ে সাহিত্য রচনার চেষ্টা করেন অবিরত৷
একইমত আর্টিকেল

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন

- Advertisment -
Digital Marketer Apple Mahmud Riyad

জনপ্রিয়

মন্তব্য